আম এ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। ছোট-বড় সবার পছন্দনীয় এই ফলটির উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। স্বাদ ও জনপ্রিয়তার জন্য আমকে বাংলাদেশে ফলের রাজা বলা হয়। পুষ্টি উপাদান ও বহুবিধ ব্যবহারের কারণে অন্য কোনো ফলের সাথে আমের তুলনা হয় না। পাকা আম উচ্চমানসম্পন্ন ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ এবং খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ। আম সাধারণত বাংলাদেশের সব এলাকায় আবাদ হয়, তবে উঁচু মান, স্বাদ ও অধিক উৎকৃষ্ট আম চাষের উপযোগী মাটি ও কৃষি জলবায়ুর জন্য দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সর্বাধিক আম আবাদ হয়। বর্তমানে কিছু কিছু পাহাড়ি এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উচ্চফলনশীল মানসম্পন্ন আমের চাষাবাদ হচ্ছে। আম ওই এলাকার মানুষের আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। বিবিএস, ২০১৭ অনুযায়ী দেশে ৩৭৮৪৬ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়, যার উৎপাদন প্রায় ১১.৬১ লক্ষ মেট্রিক টন তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা অনুযায়ী আম চাষাবাদের এলাকা ও উৎপাদন উভয়ই বেশি। তাদের মতে, ১ লক্ষ ৭৪ হাজার ২০৮ হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয় এবং এর উৎপাদন ২১ লক্ষ ৪৩ হাজার ৪০৩ মেট্রিক টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়, যার উৎপাদন প্রায় ৩.০ লক্ষ মেট্রিক টন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে ২৩টি জেলায়। অন্য ফসলের তুলনায় লাভজনক হওয়ায় নতুন নতুন জেলায় আম বাগান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিভিন্ন জেলায় আমের বর্তমান অবস্থা ভিন্ন ধরনের। কোনো জেলায় আম এখন মার্বেল আকারের, কোথাও আবার মটরদানাকৃতি আবার কোথাও কেবল গুটিবাঁধা সম্পন্ন হয়েছে। ভালোমানের আম উৎপাদনে ব্যবস্থা নিতে হবে এখন থেকেই। আমের গুটি বাঁধা সম্পন্ন হলেই একটি কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের ব্যবহার করতে হবে। মেঘমুক্ত ও রৌদ্র উজ্জ্বল দিনে স্প্রে করলে তা বেশি কার্যকর হয়। তবে স্প্রে হতে সবচেয়ে বেশি সুফল পেতে সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক ডোজ বা মাত্রা নির্ধারণ, সঠিক সময় নির্বাচন এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তবে কোনো কোনো আম উৎপাদনকারী এলাকায় আম উৎপাদনে ককটেলের ব্যবহার করে থাকেন। ককটেল বলতে একাধিক কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও হরমোনের একত্রে নিম্নমাত্রার ব্যবহারকে বুঝানো হয়েছে। তাদের মতে, একটি কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক কোনো একটি রোগ ও পোকামাকড় দমনে যথেষ্ট নয়। যদিও সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে, এই ককটেল কখনও কার্যকরী হতে পারে না। তাদের মতে, যে কোনো বালাইনাশক যদি পরিমিত মাত্রায় কার্যকরী উপাদান থাকে এবং সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয় তাহলে নির্দিষ্ট বালাইনাশক নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট। এখন থেকে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত আমবাগানে বহুবার বালাইনাশক ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়। আমের বৃদ্ধিকালীন বর্ষাকাল হওয়ায় বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়। আর এসবের আক্রমণ থেকে আমকে রক্ষা করেতে বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়ে যায়, যা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়। এখন সবার প্রচেষ্টা কিভাবে সবচেয়ে কম বালাইনাশক ব্যবহার করে ভালোমানের আম উৎপাদন করা যায়। প্রথমেই যেটি আসে তা হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা। আমবাগান সব সময় পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে। প্রতি বছর মরা ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে প্রুনিং ও ট্রেনিং করতে হবে। আলোক ফাঁদ, ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ট্রাপ ব্যবহার করতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ পদ্ধতিটি আমের মাছি পোকা দমনে বেশ কার্যকর। তবে সবাই মিলে একত্রে ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়। সবশেষে বালাইনাশকের ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টিবহুল দেশে উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো ততটা কার্যকর নয় ফলে চাষিরা বালাইনাশকের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। তবে বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কর্তৃক উদ্ভাবিত ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি ভালোমানের আম উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। ধারাবাহিকভাবে সুফল পাওয়ায় এই প্রযুক্তিটি ইতোমধ্যেই সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসেবে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রকৃতপক্ষে মাঠপর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন করতে গিয়ে চাষিদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রোগ, পোকামাকড় ও প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট সমস্যা। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই সব সমস্যাকে সমাধান করা যায়। ফ্রুট ব্যাগিং বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় বিশেষ ধরনের ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায় এবং এর পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছেই লাগানো থাকবে ব্যাগটি। এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রঙ এবং আকারের হয়ে থাকে। তবে আমের জন্য দুই ধরনের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙিন আমের জন্য সাদা রঙের ব্যাগ এবং অন্য সব আমের জন্য দুই স্তরের বাদামি ব্যাগ। বর্তমানে আমচাষিরা দুই স্তরের বাদামি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করছেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত ফলসমূহ নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানি উপযোগী।
ব্যাগিং করার উপযুক্ত সময়
আমের প্রাকৃতিকভাবে ঝরা বন্ধ হলেই ব্যাগিং শুরু করতে হবে। তবে বারি আম-১, গোপালভোগ, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, বারি আম-২, বারি আম-৬ এবং বারি আম-৭ জাতের ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা হয় ৪০-৫৫ দিন বয়সে। এই সময়ে আম জাতভেদে মার্বেল আকার বা এর চেয়ে আকারে বড় হয়ে থাকে। তবে বারি আম-৩, ৪, ৮, ফজলি, হাঁড়িভাঙ্গা, আশ্বিনা এবং গৌড়মতি আমের ক্ষেত্রে গুটির বয়স ৬৫ দিন হলেও ব্যাগিং করা যাবে। ব্যাগিং করার আগে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালোভাবে মিশিয়ে শুধু ফলে স্প্রে করতে হবে। ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা ঠিক নয়। আমের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনটি স্প্রে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। যেমন-প্রথমবার আমগাছে মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন আগে, দ্বিতীয়বার মুকুল আসার পর অর্থাৎ আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেমি. লম্বা হবে কিন্তু ফুল ফুটবে না এবং আম যখন মটর দানার মতো হবে তখন একবার। সুতরাং এর পরপরই আমে স্প্রে করে ব্যাগিং করার পরামর্শ দেয়া হয়। ব্যাগিং করার আগেই মরা মুকুল বা পুষ্পমঞ্জরির অংশবিশেষ, পত্র, উপপত্র অথবা এমন কিছু যা ফলের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
যেসব এলাকায় আম বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয় না বা শুধুমাত্র পারিবারিক চাহিদা পূরণে আমগাছ লাগানো হয়েছে এবং এসব গাছে সময়মতো স্প্রে করা হয় না বা সেই ধরনের প্রচলন এখনও এলাকায় চালু হয়নি ফলে প্রতি বছরই তাদের গাছে আম ধরে কিন্তু পোকা ও রোগের কারণে অধিকাংশ আম নষ্ট হয়ে যায়। এসব আমগাছে এই প্রযুক্তিটি সবচেয়ে কার্যকর। এ ছাড়াও যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয় এবং আম দেরিতে পাকে সেসব আমের জাত বিবর্ণ বা কালো রঙ ধারণ করতে দেখা যায় এবং মাছি পোকার আক্রমণ দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় নাবী জাত আশ্বিনাতে ১০০ ভাগ আমের মাছি পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যায়। যে সব বাগানে ঘন করে আম লাগানো হয়েছে এবং বর্তমানে গাছের ভেতরে সূর্যের আলো পৌঁছায় না সে সব গাছে আমের মাছি পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মাছি পোকা দমনের জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বা প্রচলিত আছে কোনোটিতেই এই মাছি পোকাকে শতভাগ দমন করা সম্ভব নয় বরং আক্রমণের হার কিছুটা কমিয়ে রাখা যায়। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে শতভাগ রোগ ও পোকামাকড় দমন করা যায়। আম রপ্তানির জন্য ভালো মানসম্পন্ন, রঙিন ও রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত আম প্রয়োজন। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে এই তিন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন আম রপ্তানিকারক দেশে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি দ্বারা সবচেয়ে কম পরিমাণে বালাইনাশক ব্যবহার করে ১০০% রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত আম উৎপাদন করা সম্ভব। এ ছাড়াও ব্যাগিং করা আম সংগ্রহের পর ১০-১৪ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায়। সেই সাথে রঙিন, ভালো মানসম্পন্ন নিরাপদ আমও পাওয়া যায়। ব্যাগিং প্রযুক্তি হতে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য কয়েকটি বিষয়ের প্রতি অবশ্যই নজর দিতে হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাগিং করতে হবে। ব্যাগিং করার আগে আমগুলো কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে শুধুমাত্র ফলে স্প্রে করতে হবে। ব্যাগিং করার কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা আগে স্প্রে করতে হবে। তবে স্প্রে করার পরের দিনও ব্যাগিং করা যাবে যদি বৃষ্টিপাত না হয়। ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা উচিত নয়। সঠিক নিয়মকানুন ও পদ্ধতি অনুসরণ করে যে সব চাষি ব্যাগিং করছেন তারা বেশ ভালো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। নিরাপদ, বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য এটি একটি সহজ ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি হিসেবে মাঠপর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছে।
আম বাগানে সেচ প্রয়োগ
ভালোমানের আম উৎপাদনে সেচের বিকল্প নেই। আমগাছে মুকুল আসার আগে সেচ না দেয়া উত্তম তবে মুকুল আসার পর সেচ দিতে তেমন বাধা নেই। তবে আমগাছে গুটিবাঁধার পর একটি নির্দিষ্ট ব্যবধানে সেচ প্রয়োগ করতে হবে। মাটির অবস্থা বুঝে মাসে এক থেকে দুইবার সেচ প্রয়োগ করলেই হয়। তবে অনেক আম উৎপাদনকারী দেশে জলীয় বাস্প আকারে আমগাছে পানি দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে একটি আমবাগানে মাসে ৩-৪ বার পানি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিতে সেচের পানিও কম ব্যবহার হয়। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার জন্য প্রযুক্তিটি অত্যন্ত কার্যকর।
পরিশেষে, নিরাপদ, বিষমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত আমের উৎপাদন বৃদ্ধি হোক এটি সবার প্রত্যাশা। আমাদের আমচাষিরা ভালোমানের গুণগতমানসম্পন্ন আম উৎপাদনে উপরোক্ত বিষয়সমূহ ভালোভাবে অনুসরণ করবেন তাহলেই ভালোমানের আম উৎপাদন নিশ্চিত হবে।
ড. মো. শরফ উদ্দিন
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, আকবরপুর, মৌলভীবাজার, মোবা : ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল :sorofu@yahoo.com